মন্তব্য কলাম : সাংবাদিকতা না কন্টেন্ট-ব্যবসা: পার্থক্যটা বুঝি, আস্থা বাঁচাই

দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন
0
\ মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল \
দেশে প্রায়ই শোনা যায় “সংবাদের চেয়ে সাংবাদিক নাকি বেশি!” কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে যে খবর শোনা যায়, সেখানে আবার একটি মানসম্মত সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, খালি পড়ে আছে ডেস্ক। এই দুই বাস্তবতা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা যেন সময়ের এক অদ্ভুত ছবি শব্দের কোলাহল আছে, কিন্তু আস্থার অভাব; মানুষ খবর পায়, কিন্তু যাচাই করা সংবাদ পায় না।
আজ অনেকে মাইক্রোফোনে লোগো লাগিয়ে, ‘প্রেস’ লেখা জ্যাকেট পরে, মোবাইল ক্যামেরা হাতে লাইভে আসেন এরা সবাই সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন না। কেউ কেউ ইউটিউব বা ফেসবুকে নিয়মিত কন্টেন্ট বানান, বিজ্ঞাপন থেকে আয় করেন, স্পনসর নেন; এটা তাদের প্রাপ্য অধিকার ব্যবসা করা অপরাধ নয়। কিন্তু এই কাজটি সাংবাদিকতা নয়। সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের অনুমোদিত কোনো টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র বা নিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালের আলোকে সংগঠিত, নীতিমালা-নির্ভর ও দায়বদ্ধ এক জনসেবা। সেখানে একজন রিপোর্টার একা নন তার পেছনে থাকে নিউজরুম, ডেস্ক, সাব-এডিট, কপিএডিট, ফ্যাক্টচেক, আইনি পরামর্শ এবং সবশেষে সম্পাদকীয় দায়। এই ধারাবাহিকতা ভেঙে দিলে সেটি আর সাংবাদিকতা থাকে না; তখন তা হয় ব্যক্তিগত সম্প্রচার বা কনটেন্ট-ব্যবসা। বোঝাপড়াটি সহজ। ইউটিউবার বা ব্লগার প্রথাগত অর্থে কাউকে জবাবদিহি নাও করতে পারেন; তাঁদের লক্ষ্য প্রধানত দর্শকসংখ্যা, সাবস্ক্রাইবার, স্পনসর। একজন সাংবাদিককে তার সংস্থা, পেশার নীতিমালা, আইন এবং সর্বোপরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তিনি হেডলাইনের চেয়ে তথ্যের সত্যতা বড় করে দেখেন; “সবচেয়ে আগে” পৌঁছানোর তাড়নার চেয়ে “সবচেয়ে ঠিক” পৌঁছানোকে অগ্রাধিকার দেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে ‘অন্য পক্ষের বক্তব্য’ নেন, একটি তথ্য দুই-তিনটি সূত্রে মিলিয়ে দেখেন, প্রয়োজন হলে প্রকাশ দেরি করেন কারণ ভুল খবরের দায় ব্যক্তিগত নয়, প্রতিষ্ঠানগত; ক্ষতিটাও সামাজিক।
তাহলে মানসম্মত সাংবাদিকের সংকট কেন? প্রথমত, দক্ষতা গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া বিট বোঝা, নথি পড়া, সংখ্যার ভাষা বুঝে লেখা, কঠিন প্রশ্ন করার সাহস, মানবিকতা না হারিয়ে ক্ষমতাকে জবাবদিহির সামনে দাঁড় করাতে পারা এসব রাতারাতি শেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, নিউজরুমে মেন্টরশিপ কমে গেছে; লম্বা সম্পাদনা-শৃঙ্খলা ভেঙে ফাস্ট-কনটেন্টের চাপ বেড়েছে। তৃতীয়ত, বিজ্ঞাপনী বাজারের টানাপোড়েন আর্থিক অনিশ্চয়তা যোগ্য তরুণদের টিকে থাকতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে পর্দায় “সাংবাদিক” বেশি, কিন্তু নিউজরুমে রিপোর্টার কম।
এদিকে, “যাকে তাকে সাংবাদিক” তকমা দেওয়া শুধু পেশাকে ছোট করে না জনআস্থা ক্ষয়ে যায়। ভুয়া ‘ব্রেকিং’, কাঁচা ‘লাইভ’, যাচাইহীন ‘এক্সক্লুসিভ’ এসব মুহূর্তে ক্লিক বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে আস্থা নামায়। গুজব ছড়ায়, নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তদন্ত আটকে যায়, সামাজিক বিভাজন বাড়ে। মনে রাখুন, আমরা যেটি দেখি, শেয়ার করি, সেটিকেই শক্তি দিই। যে কন্টেন্টকে গালি দিয়ে থুথু ছুড়ি, সেটির ভিউ বাড়িয়ে আমরা নিজেরাই তাকে পুরস্কৃত করি। তাই না দেখারও তো অধিকার আছে এটি প্রয়োগ করি। ভালো সাংবাদিকতাকে সাবস্ক্রাইব করি, ভুলকে রিপোর্ট করি, সংশোধন চাই।
সাংবাদিকতা যে কেবল “কে আগে বলল” তার প্রতিযোগিতা নয়, বরং “কার কথা বলল” তার নৈতিক দায়। কোনো দুর্ঘটনায় ক্যামেরা নামাতে না পারা নয়, বরং মানবিকতার স্বার্থে কখন ক্যামেরা নামাতে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়াই পেশাদারি। কোনো শক্তিশালী ব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপ্রিয় প্রশ্ন করা সাহস; আবার কোনো দুর্বল মানুষের ব্যক্তিগত বেদনা প্রকাশের আগে তার সম্মতি নেওয়া সংবেদনশীলতা দুটিই সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড। এবং এই মেরুদণ্ড গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানগত সংস্কৃতিতে: কপিএডিটরের লাল দাগ, আইনি পরামর্শকের সতর্কতা, নিউজমিটিংয়ের কঠিন জেরা, ‘রাইট টু রিপ্লাই’র চর্চা, ভুল হলে প্রকাশ্যে ‘করেকশন’ এসবের সমাহারেই তৈরি হয় আস্থার পেশা।
এখানে নাগরিকেরও দায়িত্ব আছে। আমরা যেমন কর-দিই, তেমনি তথ্যের বাজারেও ‘ভোট’ দিই ক্লিক, সময়, শেয়ার দিয়ে। ক্লিকবেইটকে না বললে, যাচাই করা সংবাদের পাশে দাঁড়ালে, পেইড-প্রোমোশন ও সংবাদের পার্থক্য বুঝে প্রশ্ন করলে বাজার নিজেই বদলাবে। স্কুল-কলেজে ‘মিডিয়া লিটারেসি’ দরকার; পরিবারে ‘ভেরিফাই না করে ফরোয়ার্ড নয়’ এই অভ্যাস দরকার। গণমাধ্যমও যদি স্বচ্ছতা দেখায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব লিখে দেয়, অর্থের উৎস জানায়, ভুল হলে খোলাখুলি দুঃখপ্রকাশ করে তাহলে আস্থা ফেরে। আস্থা ফিরলে বিজ্ঞাপনদাতাও গুণমানকে পুরস্কৃত করে; গুণমান পুরস্কৃত হলে তরুণরা এই পেশায় থাকতে চায়।
“ডেস্ক খালি” এই দীর্ঘশ্বাস ভাঙতে হলে আরেকটি সত্য মানতে হবে: সাংবাদিকতা কোনো উড়ো প্রতিভা নয়; এটি শ্রম, শৃঙ্খলা ও নীতির শিল্প। ফিল্ডের রিপোর্টারকে সময় দিয়ে বড় হতে দিতে হয়; প্রশিক্ষণ, সুরক্ষা, আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হয়; সংবাদ-সংগ্রহের খরচকে ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে বিজ্ঞাপন বিভাগ ও নিউজরুমের দেয়াল অটুট রাখতে হবে। পাঠক-দর্শকের সমর্থনকে কেবল সংখ্যা নয়, সম্পদ হিসেবে গণ্য করতে হবে। আবেগ নয়, আস্থার অর্থনীতি গড়তে হবে।
ইউটিউবার বা ব্লগারকে প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো কারণ নেই; তারা বিভিন্ন সময় ভালো গল্পও বলেন, সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেন। কিন্তু পেশার সংজ্ঞা মুছে দিলে হিসাব গড়মিল হয়ে যায়। কন্টেন্ট-ক্রিয়েটর নিজের জন্য কাজ করেন এতে দোষ নেই। সাংবাদিক জনস্বার্থে কাজ করেন এতে দায়িত্ব আছে। এই পার্থক্যটুকু ঠিক রেখে পথ চললে দুই ক্ষেত্রই টিকে থাকবে, সমাজও লাভবান হবে।
আমরা যদি দর্শক হিসেবে দায়িত্বশীল হই, গণমাধ্যম যদি পেশাদারিত্বে আপসহীন থাকে, এবং নতুন প্রজন্মের রিপোর্টারদের আমরা যদি সম্মান-শিক্ষা-সমর্থন দিই, তাহলে “সংবাদের চেয়ে সাংবাদিক বেশি” এমন তাচ্ছিল্য একদিন থামবে। তখন মাইকে লাগানো লোগোর ঝলক নয়, সত্য যাচাই করা শব্দের আলোয় দেশ দেখবে নিজেকে আর সেটাই হবে গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় জয়।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)