![]() |
মুর্শেদ ইকবাল রীমু পরিচালক, কর্মসূচি, উন্নয়ন সংঘ |
বর্তমান বিশ্ব এক অস্থির ও অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্থিন যুদ্ধ, ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব, এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ভয়াবহ উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে। পরাশক্তিগুলোর সামরিক প্রস্তুতি, পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকায়ন এবং আঞ্চলিক সংঘাতের বিস্তার দেখে অনেকেই আশঙ্কা করছেন—তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আমাদের দোরগোড়ায়?
যদিও এখনো এই যুদ্ধ বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি, তবে ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়—যুদ্ধ কখনো পূর্বঘোষিত হয় না বরং হঠাৎ করেই তা বিস্ফোরিত হয়। আর একবার শুরু হলে, তার প্রভাব শুধু যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ, রাজনীতি—সবকিছুই এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।
বাংলাদেশ, একটি উন্নয়নশীল, আমদানিনির্ভর এবং ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল দেশ হিসেবে, এমন বৈশ্বিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের অর্থনীতি বহুলাংশে বৈশ্বিক বাণিজ্য, রেমিট্যান্স ও আমদানির উপর নির্ভরশীল। একইসঙ্গে, আমরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছি, যা আমাদেরকে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক ও সামরিক হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
আজ এখানে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো যুদ্ধ আরো ব্যপক আকারে সংগঠিত হলে বাংলাদেশের উপর কী কী সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে এবং সেই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও নাগরিক পর্যায়ে আমাদের করণীয় কী হতে পারে। কারণ, সচেতনতা ও প্রস্তুতিই হতে পারে যেকোনো বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার।
সম্ভাব্য প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি কেবল জরুরি নয় বরং তা হতে হবে সুপরিকল্পিত, বাস্তবভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি। নিচে প্রতিটি করণীয় বিশ্লেষণ করে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি যা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিক্ষিপ্ত ভাবনা:
১. অর্থনৈতিক বিপর্যয়
▸ আমদানি-রপ্তানি বিঘ্ন
বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা অত্যন্ত বেশি—বিশেষ করে জ্বালানি, খাদ্য, সার, কাঁচামাল ও প্রযুক্তিপণ্যে। যুদ্ধ স্থায়ী হলে সমুদ্রপথে নিরাপত্তা সংকট দেখা দেবে, বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল ব্যাহত হবে। এতে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে। তৈরি পোশাক খাত, যা রপ্তানির ৮০% এর বেশি, তা সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়লে বিপর্যস্ত হবে।
▸ মুদ্রাস্ফীতি ও বাজার অস্থিরতা
জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ডলারের চাহিদা বাড়বে, ফলে টাকার মান কমে যাবে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
▸ বিনিয়োগে ধস
যুদ্ধকালীন অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে পুঁজি সরিয়ে নিতে পারেন। এতে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, নতুন শিল্প স্থাপনে ভাটা পড়বে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে।
২. রেমিট্যান্স ও অভিবাসী সংকট
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কর্মরত শ্রমিকরা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চাকরি হারাতে পারেন, অথবা নিরাপত্তার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হতে পারেন। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করবে এবং অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে।
৩. জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎ বিপর্যয়
যুদ্ধের সময় হরমুজ প্রণালি, সুয়েজ খাল বা মালাক্কা প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের আমদানিকৃত তেলের বড় অংশ এই পথগুলো দিয়ে আসে। সরবরাহ ব্যাহত হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে, শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং লোডশেডিং বেড়ে যাবে।
৪. খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে
বাংলাদেশ গম, ভুট্টা, চিনি, ভোজ্যতেলসহ অনেক খাদ্যপণ্যের জন্য আমদানিনির্ভর। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যাহত হলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
৫. সামরিক ও কূটনৈতিক চাপে পড়া
বিশ্বযুদ্ধের সময় বড় শক্তিগুলো ছোট দেশগুলোকে তাদের জোটে টানার চেষ্টা করে। বাংলাদেশকে কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) বা চীন-রাশিয়া জোটে যোগ দেওয়ার চাপ আসতে পারে। এতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে এবং কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে।
৬. সামাজিক অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি
যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে গুজব, ভুয়া খবর ও উসকানিমূলক প্রচারণা ছড়াতে পারে। এতে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতা সৃষ্টি হলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
৭. স্বাস্থ্য খাতে চাপ
যুদ্ধের কারণে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও কাঁচামালের আমদানি ব্যাহত হতে পারে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে গেলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সংকোচন হবে। এতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা ব্যাহত হবে এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়বে।
৮. মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহনশীলতা
যুদ্ধের আতঙ্ক, অর্থনৈতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হতাশা, উদ্বেগ, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে সামাজিক সহনশীলতা ও পারস্পরিক আস্থার অবনতি ঘটবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির পাশাপাশি নাগরিক পর্যায়ের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে প্রতিটি করণীয়কে বিশ্লেষণ করে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:
১. অর্থনৈতিক সংযম অনুশীলন
যুদ্ধকালীন সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পণ্যের ঘাটতি ও আয় হ্রাস—এই তিনটি চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে দেখা দিতে পারে। তাই নাগরিকদের উচিত:
• অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো: বিলাসী জীবনযাপন থেকে বিরত থাকা, যেমন: অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ, বিলাসবহুল পণ্য কেনা ইত্যাদি।
• সঞ্চয় বাড়ানো: ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় আয় অনুযায়ী সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা।
• স্থানীয় উৎপাদন ও সেবা ব্যবহার: দেশীয় পণ্য ও সেবার প্রতি আস্থা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা।
২. তথ্য যাচাই করে শেয়ার করা
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গুজব, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজে আতঙ্ক ও বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।
• সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়িত্বশীল আচরণ: কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তার উৎস যাচাই করা।
• সরকারি বা নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম অনুসরণ: তথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাইকৃত উৎস ব্যবহার করা।
• গুজব প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা: পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।
৩. সামাজিক সংহতি বজায় রাখা
সংকটকালে বিভাজন নয়, বরং ঐক্যই পারে জাতিকে রক্ষা করতে।
• ধর্ম, মত ও জাতিগত সহনশীলতা: ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে বিরত থাকা।
• সহযোগিতার মনোভাব: প্রতিবেশী, দরিদ্র ও দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো।
• স্থানীয় নেতৃত্বকে সহায়তা: সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী দল ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করা।
৪. স্থানীয় পণ্যের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানো
যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যাহত হলে দেশীয় উৎপাদনই হবে ভরসা।
• দেশীয় কৃষিপণ্য ব্যবহার: স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহিত করা ও বাজারে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ানো।
• হস্তশিল্প ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য বেছে নেওয়া: এতে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা সহজ হবে।
• ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়া: জাতীয় আত্মনির্ভরতার চেতনা গড়ে তোলা।
৫. মানসিক স্থিতি বজায় রাখা ও পরিবারে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা
যুদ্ধের আতঙ্ক, অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
• আতঙ্ক না ছড়িয়ে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা: পরিবারে সাহস ও আশাবাদ ছড়িয়ে দেওয়া।
• সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা: শিশুদের সামনে আতঙ্কজনক আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো।
• সামাজিক বন্ধন জোরদার করা: আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।
বৈশ্বিক সংকটের সময় সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে সচেতনতা, সংযম ও সংহতি। উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি ভৌগোলিক দূরবর্তী বিষয় নয়—বরং এটি হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক ও মানবিক নিরাপত্তার জন্য এক গভীর হুমকি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতার মধ্যেও আমাদের করণীয় হলো সংযত, সচেতন ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। রাষ্ট্রকে নিতে হবে দূরদর্শী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ; নাগরিকদের গড়ে তুলতে হবে সহনশীল, সংহত ও দায়িত্বশীল চরিত্র। এই সংকটকালে আমাদের শক্তির মূল উৎস হতে পারে—তথ্যভিত্তিক সচেতনতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সম্মিলিত সহনশীলতা।
আমাদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে রক্ষা করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে পারে। যুদ্ধ যদি অনিবার্য হয়, তাহলে আমাদের প্রস্তুতি হওয়া উচিত তা প্রতিহত করতে নয়—বরং তা মোকাবিলা করে টিকে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ে। কারণ, শান্তির চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র পৃথিবীতে নেই।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন