![]() |
\ মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল \ |
টিউবওয়েলপাড় মোড়ে হাঁটা মানুষই সংখ্যায় বেশি। কেউ বিদ্যুতের বিল দিতে যাচ্ছে, কেউ ওষুধ কিনছে, কেউ ফটোকপি বা কাগজপত্রের কাজ সেরে এপাশ-ওপাশ দৌড়োচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ, গর্ভবতী সবাই এখানে নিয়মিত পারাপার হন। অথচ নিরাপদ পারাপারের স্থায়ী আয়োজন নেই; ফুট ওভারব্রিজ নেই, দৃশ্যমান জেব্রা ক্রসিং নেই, রাতে আলোর ঘাটতিও থাকে। ফল যা হওয়ার তাই চালকের এক মুহূর্তের অসচেতনতা, পথচারীর এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত, আর একটি পরিবারে দীর্ঘশ্বাস।
সমাধান অগম্য নয়; বরং খুবই বাস্তব ও হাতের নাগালে। প্রথম কাজ ভালো মানের উপকরণে স্পিড ব্রেকারগুলো জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা এবং প্রয়োজন হলে ‘রেইজড পেডেস্ট্রিয়ান ক্রসিং’ হিসেবে নতুন করে নির্মাণ করা, যাতে গতি স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসে এবং পথচারী অগ্রাধিকার পায়। স্পিড ব্রেকারের উচ্চতা-ঢাল সঠিক মানে না হলে সেটি গাড়ির জন্য যন্ত্রণা, পথচারীর জন্য ভাঁওতা দুটোই হয়; তাই মাপজোক ঠিক থাকতে হবে এবং উজ্জ্বল প্রতিফলক রঙে চিহ্নিত করতে হবে, যাতে রাতেও দূর থেকে ধরা পড়ে। মোড়ের আগ-পিছনে রাম্বল স্ট্রিপ ও ‘স্লো’ সাইন চোখে লাগার মতোভাবে বসানো জরুরি। একই সঙ্গে মোড়ের কেন্দ্রে ছোট ‘ট্রাফিক আইল্যান্ড’ বা মিনি-রাউন্ডঅ্যাবাউট করলে বেপরোয়া সোজা গতি ভেঙে নিয়ন্ত্রিত ঘুর্ণন তৈরি হয় সংঘর্ষের কোণ ও ক্ষতি দুটোই কমে। কেউ কেউ যুক্তি দেবেন “একটা ফুট ওভারব্রিজ হলেই তো সব মিটে যায়!” ওভারব্রিজ অবশ্যই বিবেচ্য; তবে বাস্তবে অনেক সময়ে মানুষ সোজা পথটাই নেয়। তাই প্রথমে মাটির সমতলে নিরাপদ পারাপারের আয়োজন শক্ত করা দরকার স্পষ্ট জেব্রা ক্রসিং, মিডিয়ান রিফিউজি আইল্যান্ড, পর্যাপ্ত আলো, এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানববল দিয়ে ক্রসিং নিয়ন্ত্রণ। যদি তবু পারাপারে ভিড় ও গতি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তখনই ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসের মতো পরবর্তী সমাধান গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত। লক্ষ্য একটাই মানুষ যেন নিরাপদে, সহজে ও স্বাভাবিক অভ্যাসে রাস্তা পার হতে পারে।
শুধু অবকাঠামো করলেই হবে না; নিয়ম-প্রয়োগ ও শৃঙ্খলাও সমান জরুরি। শহরমধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী বাস, ট্রাক, পিকআপ ও মোটরসাইকেলের গতি সীমা কড়া হাতে মানাতে হবে। নিয়মিত মোবাইল টহল, পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা, জরিমানার দৃশ্যমানতা এসব চালকের মনে দায়িত্ববোধ ফেরায়। এই মোড়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের জীবন-যাতায়াত জড়িয়ে। দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা উত্তেজিত হই, ক্ষোভ ঝাড়ি, তারপর সব শান্ত হয়ে যায়। পরবর্তী দুর্ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত। এই চক্র ভাঙতে হবে ‘ডেটা’ ও ‘ডিসিপ্লিন’ দিয়ে। কোন সময়ে দুর্ঘটনা বেশি, কোন দিক থেকে গতি বেশি, কোন অংশে আলো কম এগুলো নথিবদ্ধ করলে সমাধান লক্ষ্যভেদী হয়।
সবশেষে, আমরা সবাইকেই নিজের ভূমিকা বুঝতে হবে। চালক হিসেবে গতি মানাই জীবনমান; পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছানোর আনন্দ কারও সারাজীবনের কান্নায় বদলে যেতে পারে। পথচারী হিসেবে ক্রসিং দিয়ে পার হই, মোবাইল দেখে হাঁটা নয়, রাত হলে উজ্জ্বল রঙের পোশাক বা ছোট প্রতিফলক ব্যবহার করি। দোকানদার হিসেবে দোকানের সামনে পারাপারের জায়গা খালি রাখি, ব্যস্ত সময়ে স্বেচ্ছাসেবীভাবে মানুষ পারাপারে সহায়তা করি। একদিনের প্রচার নয়, প্রতিদিনের চর্চা এতেই নিরাপত্তা অভ্যাসে পরিণত হয়।
টিউবওয়েলপাড় মোড় শহরের গতিশীলতার প্রতীক; এটিই আমাদের পরীক্ষা আমরা কি গতি-ভিত্তিক শহর চাই, নাকি জীবন-সম্মত শহর? স্পিড ব্রেকারগুলো সংস্কার করা এখনই সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে দ্রুত ফলদায়ী কাজ। তার সাথে আলোকসজ্জা, চিহ্নায়ন, শৃঙ্খলা ও মানবিক আচরণের সমন্বয় হলে এই মোড় আবার নিরাপত্তার নজির তৈরি করতে পারে। শহরের উন্নয়ন শুধু বড় প্রকল্পে নয় এমন ছোট, নির্ভুল, দৈনন্দিন সিদ্ধান্তেই ধরা পড়ে। আজ যদি আমরা টিউবওয়েলপাড় মোড়কে নিরাপদ করি, কাল জামালপুরের প্রতিটি মোড়েই সেই স্ট্যান্ডার্ড আমাদের পথ দেখাবে। গতি একটু কম, কিন্তু জীবন অটুট আমাদের শহরের জন্য এটাই হোক নতুন শপথ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন