![]() |
\ মোঃ সাইদুর রহমান সাদী \ |
বাংলাদেশের নগর ও শহরতলির পরিবহনে অটোরিকশা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বাহন। ব্যস্ত নগরের অলিগলি থেকে শুরু করে উপজেলা সদরের প্রান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও এখন তিন চাকার এই বাহনই অন্যতম ভরসা। কিন্তু এই জনপ্রিয় বাহনই আজ অনেক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন এটি চলে প্রশিক্ষণহীন চালকের হাতে, অগোছালো ট্রাফিক পরিবেশে। বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় প্রায় ৫-৬ হাজার মানুষ এবং আহত হন আরও কয়েক গুণ বেশি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সড়কে দুর্ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ব্যাটারিচালিত বা ইঞ্জিনচালিত অটোরিকশা ও তিন চাকার যানবাহন সংশ্লিষ্ট। অনেক সময় এই দুর্ঘটনার শিকার শুধু যাত্রী নয়, পথচারী এবং অন্যান্য যানবাহনের চালকও হন। একটি বড় সমস্যা হলো, এই বাহনগুলোর চালকদের বড় অংশেরই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অটোচালকরা নিজেরাই চালানো শিখে যান চলাচলে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ট্রাফিক আইন, গতির নিয়ন্ত্রণ, হর্ন ব্যবহার, পথচারীর প্রতি সচেতনতা কিংবা পার্কিং নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। এর ফলে সড়কে তারা যেমন নিজের জীবনের ঝুঁকি বাড়ান, তেমনি অন্যদের জন্যও সৃষ্টি করেন হুমকি।
অন্যদিকে, অটোরিকশা বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত বা 'ইজিবাইক'—এই বাহনগুলো অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে গতিশীল, ওভারলোডেড বা অননুমোদিত হয়ে পড়ে। অনেক চালক ৮-১০ জন যাত্রী বহন করছেন একটি ক্ষুদ্র বাহনে, যার ভারসাম্য বা ব্রেকিং সিস্টেম সেই অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়নি। আবার অনেকেই যানটি চালাচ্ছেন মূল রাস্তার মাঝখানে, হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন যাত্রী তুলতে, যা পরবর্তী যানবাহনের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় নির্ধারণে আমরা প্রায়ই ফিটনেসবিহীন বাস বা বেপরোয়া ট্রাকচালকের দিকে নজর দিই, অথচ যে অগণন ছোট ছোট দুর্ঘটনা প্রতিদিন অটোরিকশার অসতর্ক বা অপটু চালনার কারণে ঘটছে, সেগুলো আমরা হিসাবের বাইরে রাখি। অথচ এগুলোর ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, আহত মানুষ, কর্মক্ষমতা হারানো ব্যক্তি।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাধান কী?
এখানে কঠিন কোনো প্রযুক্তি নয়, বরং প্রাথমিক ও বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণই হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ। স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন কিংবা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অটোচালকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রশিক্ষণের আওতায় আনা উচিত—ট্রাফিক আইন, সংকেত বোঝা, জরুরি ব্রেকিং, যাত্রী নিরাপত্তা, গতি নিয়ন্ত্রণ ও চালনার শিষ্টাচার বিষয়গুলো। পাশাপাশি, লাইসেন্স ছাড়া কেউ যেন যান চালাতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে কঠোর নজরদারি ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের একটি ডিজিটাল রেজিস্ট্রি তৈরি করা হলে, ভবিষ্যতে অটোচালকের মান যাচাই ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই উদ্যোগকে যেন দমনমূলক না করে সচেতনতামূলক রাখা হয়। কারণ অধিকাংশ অটোচালকই সমাজের নিম্নআয়ের মানুষ, যারা জীবিকার তাগিদে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাদের দৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ যদি হয় রোজগারের পথে বাধা, তবে তারা তা এড়াতে চাইবেন। কিন্তু যদি এটিকে উন্নয়নের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়—সচেতন চালক মানে নিরাপদ যাত্রী, নিরাপদ সড়ক—তবে তাতে সবাই উপকৃত হবেন। সড়কে নিরাপত্তা শুধু বড় যানবাহনের দায় নয়। ছোট বাহন, অদৃশ্য সমস্যা এবং ‘সহজভাবে মেনে নেওয়া অনিয়ম’—এই তিনটিই আসলে বড় দুর্ঘটনার সূচনাবিন্দু। তাই সময় এসেছে, অটোরিকশা চালনার মতো সহজ মনে হওয়া কাজটির পেছনেও যেন থাকে প্রশিক্ষণের সুশৃঙ্খল ছায়া। এতে শুধু দুর্ঘটনাই কমবে না, বাড়বে চালকদের আত্মবিশ্বাস, পেশাগত মর্যাদা এবং সর্বোপরি—সবার জীবন নিরাপদ হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন