শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলা ভূমি অফিসগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম, টাকা লেনদেনের ভিডিও ফাঁস

দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন
0

সুলতান আহমেদ ময়না, শেরপুর প্রতিনিধি ।
ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হচ্ছেনা শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার বেশীরভাগ ইউনিয়ন ভূমি অফিস গুলোতে। প্রতিটি ভূমি অফিসে দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে এই ঘুষ বানিজ্য । কিছু দলিল লেখক ও স্থানীয় কিছু টাউট শ্রেনীর লোকেরাই হচ্ছে ওই দালাল সিন্ডিকেট সদস্য। জমি জমা দলিল করতে যেসব
কাগজপত্র প্রয়োজন। তার সাথে ভূমি অফিসের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিভিন্ন ইউনিয়নের
নানা অভিযোগ রয়েছে খড়িয়াকাজিরচর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারি ভূমি কর্মকর্তার
অফিসের অবৈধ টাকা লেনদেনের একাধিক ভিডিও চিত্র। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নামজারি, ভূমি
বিষয়ক বিভিন্ন প্রকারের সার্টিফিকেট প্রদান, ভূমি বিষয়ক অভিযোগ নিষ্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তির লিজ নবায়নের কাজে টাকা দিতে হয় মাঠ পর্যায়ের এসব ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
দোকান থেকে আবেদন করে অফিসে গিয়ে আবেদনের বিষয়টি জানানোর প্রথম ধাপেই সেবা গ্রহিতাদের কাছ থেকে নেয়া হয় ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। এ ছাড়াও কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় হাজার হাজার টাকা গুনতে হয় সেবা গ্রহিতাদের। আবার টাকা দেয়ার পরে কাগজ পেতে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস।
এছাড়াও সাংবাকিদের হাতে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, উপজেলার খড়িয়াকাজিরচর ইউনিয়নের উপ-সহকারি ভূমি কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানা অনেক হাসিখুশিতে স্থানীয় দালালের কাছ থেকে টাকা গুনে নিচ্ছেন। টাকা গণনা শেষে নিজের ব্যক্তিগত টাকার সাথে রাখেন। সেই ভিডিও’র সাউন্ডে সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ টাকা গুনে সেই কর্মকর্তাকে টাকা দেন। অনেক যত্নে টাকা সাথে সাথে গুনে রাখেন। দুইদিন পর তাকে এসে কাগজ বুঝে নেয়ার কথা বলেন। এই ভিডিও গুলোর বিষয়ে বক্তব্য চাইতে গেলে স্থানীয় সেই দালালরা সাংবাদিকদের খবর না করার জন্য চাপ দেন। এছাড়াও খবর করলে ভালো হবেনা বলে হুমকি দেন যুবদল নেতা পরিচয়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাড়ে ৭ মাস আগে যোগদান করা ওই কর্মকর্তা ঘুষ ছাড়া কোন কাজই করেন না। নামজারি কিংবা খারিজ নিতে তাকে দিতে হয় মোটা অংকের সেলামি। শুধু তাই নয়, জমি জমার বিষয় খোঁজ নিতে গেলেও দিতে হয় উৎকুচ। মূলত. জমিজমা সংক্রান্ত যেকোন কাজে ঘুষ নেয়া যেনো তার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তিনি নয়, উপজেলার প্রতিটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের চিত্র প্রায় একই। প্রতিটি অফিসে রয়েছে দালাল সিন্ডিকেট। স্থানীয় বাসিন্দা এডভোকেট মো.
শাহজাহান বলেন, ৫ তারিখকে ঘিরে ছাত্র জনতার যে আকাঙ্ক্ষা ছিলো। সরকারি সেবায় কোন বৈষম্য
হবেনা। কোন দপ্তরে ঘুষ দুর্নীতি চলবে না। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি না । তিনি আরো বলেন, আমি যেহেতু এই অফিসের সাথেই থাকি।
আমার জানামতে এই অফিসে বিন্দু পরিমান দুর্নীতিও বন্ধ হয়নি। বরং সেবাপ্রার্থীরা বাড়তি টাকা দিয়েও
কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। আমি এলাকার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আহ্বান জানাবো, যেন ভূমি
অফিসগুলোর দিকে নজর রাখা হয়। প্রকৃত সেবা গ্রহণকারীরা যেন সেবা পায়।
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক নিজাম উদ্দিন বলেন, আমি একটি কাজের জন্য ২বছর যাবৎ সরকারি
খরচের চেয়ে অনেক বেশি টাকা বাড়তি দিয়েও ঘুরতেছি। কিন্তু এখনো কাজ হয়নি। আগের কর্মকর্তা
চলে গেছে তাই এখন নতুন কর্মকর্তার কাছেও পাত্তা পাচ্ছিনা। এছাড়াও তিনি বলেন, এই অফিসে
একটা কাজ ও টাকা ছাড়া হয়না। আগে যেভাবে অফিস চলছে এখনও তেমনি আছে।
লঙ্গরপাড়ার কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন আমি জমি খারিজ করার জন্য গিয়েছিলাম। আমার কাছে
নায়েব ১০ হাজার টাকা চাইছে। আমি টাকাও দিবার পাইনাই খারিজও করবার পায়নাই। বীরবান্দা
এলাকার আলমগীর হোসেন বলেন, আমার পরিবারের একটি আবেদন দোকান থেকে নায়েব সাবের কাছে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার কাছে ১ হাজার টাকা চাইছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো ক’জন এলাকাবাসী বলেন, মানুষ আসলেই টাকা আগে- পরে কাজ।
স্থানীয় দলিল লেখকরা হচ্ছে তাদের মূল দালাল। তাদের মাধ্যমেই বড় বড় অনিয়মের কাজ গুলো করে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে টাকা নেয়ার পরেও সেবা প্রার্থীদের চরম হয়রানি করা। এ ব্যাপারে
সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ বলে বিজ্ঞ মহল্লা বাসী মনে করেন।
এ ব্যাপারে খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের উপ-সহকারি ভূমি কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানার কার্যালয়ে
গিয়ে তার বক্তব্য চাইলে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাত দিয়ে মুঠোফোন নিয়ে বাথরুমে
ঢুকে পড়েন। ১৫ মিনিট পর বের হয়ে উল্টো সাংবাদিকগণ তাকে হয়রানির অভিযোগ তুলেন এবং তিনি
ঘুষ নেননি বলে সাংবাদিকদের জানান। এ বিষয়ে শেরপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ
সম্পাদক ও শেরপুর মডেল গার্লস কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তপন সারোয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করে
বলেন, দুর্নীতি মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন সমাজে বাজে
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। সরকারি ফি এর বিপরীতে বাড়তি টাকা নেয়া আইনবিরোধী কাজ। মানুষের
উপর জুলুম। গরিব মানুষের এতে কষ্ট হয়। হয়রানি বাড়ে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বিষয়টি
কঠিন হাতে দমন করতে হবে।
বিশিষ্ট সমাজসেবক ও মানবাধিকার কর্মী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া বলেন, এতো সামাজিক
সচেতনতা বৃদ্ধি করার পরেও দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ সমস্ত নৈতিক অবক্ষয়প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া উচিত। সরকার ক্যাশলেস ডিজিটাল পদ্ধতিতে অফিস করার পরও হাতে লেনদেন কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি দেশের নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের প্রতিবাদী হতে হবে। নিয়মের বাইরে কোন টাকা যেন না দেয়। সেটাও তাদের দায়িত্ব।
এ ব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জাবের আহমেদ বলেন, সরকার ভূমি সেবাকে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার জন্য ডিজিটাল প্রক্রিয়া শুরু
করেছেন। এখানে জনগণের কাছে সরাসরি টাকা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। সব অনলাইনের মাধ্যমে
বাইরে থেকেই করে অফিসে যেতে হয়। এছাড়াও সকল প্রকার সেবার বিনিময়ে সরকার ফি নির্ধারণ
করে দিয়েছেন। সেই তালিকা জনসম্মুখে টানিয়ে রাখার নির্দেশও দেয়া আছে। এর বাইরে ও যদি টাকা
নেয়ার কোন ঘটনা ঘটে। তবে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়া হবে।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)