![]() |
\ মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল \ |
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা আজ এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে এই পেশা যে শক্তি ধারণ করে, তা কেবল তথ্য সরবরাহ নয়, বরং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য দাঁড় করিয়ে জনমত গঠনের ক্ষমতাও রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে আমাদের দেশে সাংবাদিকতার চেহারা অনেকটাই জটিল, বহুস্তরবিশিষ্ট এবং মাঝে মাঝে হতাশাজনকও বটে।
একদিকে রয়েছেন নির্ভীক ও সত্যনিষ্ঠ কিছু সাংবাদিক, যাঁরা পেশাগত নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করেন। তাঁরা দুর্নীতি, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব। ক্ষমতার কাছাকাছি গিয়েও তাঁরা মাথা নোয়ান না। সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে গিয়ে কখনো হুমকি পান, কখনো লাঞ্ছিত হন—তবু আপস করেন না। এঁরাই সাংবাদিকতার মূল মেরুদণ্ড।
অন্যদিকে, দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে এমন একদল তথাকথিত সাংবাদিক, যাঁদের কাজ তথ্য পরিবেশন নয়, বরং তথ্য বিকৃতি। হলুদ সাংবাদিকতার চর্চায় তাঁরা গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। সংবাদকে রঙচঙে করে, অতিরঞ্জিত শিরোনামে প্রকাশ করে, তারা পাঠকের আগ্রহ টেনে এনে মূলত ব্যবসায়িক লাভ দেখে। এতে সমাজ বিভ্রান্ত হয়, ভাঙে সত্যের ভিত।
আরও ভয়াবহ বাস্তবতা হলো তথাকথিত দালাল ও চামচা সাংবাদিকদের উত্থান, যারা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে কলম চালান। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করে এরা সত্যকে আড়াল করে রাখেন। সাংবাদিকতা এখানে যেন নীতির চেয়ে লেনদেনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের পাশাপাশি রয়েছে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও দলকানা সাংবাদিক, যারা অর্থ বা রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিনিময়ে রিপোর্ট চাপা দেন, বিকৃত করেন, বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবর তৈরি করেন।
উল্লেখ না করলেই নয়—বর্তমানে অর্ধশিক্ষিত, প্রশিক্ষণবিহীন কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিক সেজে ঘুরে বেড়ান। নামমাত্র কোনো অনলাইন পোর্টাল বা ফেসবুক পেজ চালিয়ে তাঁরা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দেন, অথচ তাঁদের নেই ভাষাজ্ঞান, তথ্য যাচাইয়ের ক্ষমতা কিংবা সংবাদ পরিবেশনের ন্যূনতম দায়বদ্ধতা। সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক ‘ভিউ বাড়ানো সাংবাদিকতার’ একটি বিপজ্জনক রূপও আমরা দেখতে পাচ্ছি। সংবাদকে বিনোদনে রূপান্তর করে, নকল শিরোনাম দিয়ে কিংবা নাটকীয় করে উপস্থাপন করে তাঁরা খবরের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটি হলো, এসব দুর্বৃত্ত সাংবাদিকতা জন্ম নিচ্ছে এক জটিল বাস্তবতায়। সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, মালিকপক্ষের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, পেশাগত প্রশিক্ষণের অভাব, এবং তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার সব মিলিয়ে এই পেশার ভিত দুর্বল করে দিচ্ছে।
তবুও, আমরা আশাবাদী। কারণ, এখনও কিছু তরুণ, সাহসী ও আদর্শবাদী সাংবাদিক রয়েছেন যাঁরা সকল প্রতিকূলতার মাঝেও সত্য তুলে ধরতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাঁদের অস্তিত্বই প্রমাণ করে—সাংবাদিকতা এখনো মৃত নয়, বরং এখনও তা প্রতিরোধের ভাষা, প্রতিবাদের হাতিয়ার।
এখন সময় এসেছে সাংবাদিকতা পেশাকে ঢেলে সাজানোর। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নৈতিক ও প্রশিক্ষিত সাংবাদিক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিক সমাজকে একত্রে।
সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, প্রথমেই দূষিত উপাদানগুলো দূর করতে হবে। নয়তো অদূর ভবিষ্যতেই এ পেশা হারাবে তার সম্মান, হারাবে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে নিজের অবস্থান।
সাংবাদিকতা হোক নির্ভীক, নৈতিক ও মানবিক—এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন