![]() |
মোঃ সাইদুর রহমান সাদী |
চাঁদাবাজি বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় একটি ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই এর করাল ছায়া বিস্তৃত হয়েছে—ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য পরিবহন, নির্মাণকাজ, দোকানপাট, এমনকি রাস্তাঘাটে চলাচলকারী সাধারণ মানুষও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই অসুস্থ সংস্কৃতি বহু বছর ধরে চলে এলেও বর্তমানে তা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, যার বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সমাজের ভেতরকার শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়তে পারে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি বা অন্যান্য পণ্যবাহী যান চলাচলের পথে গুটি কয়েক চাঁদাবাজের হাতে নিয়মিত অর্থ দিতে বাধ্য হয় চালক ও হেলপাররা। এই চাঁদার হার নির্দিষ্ট কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। কারো কারো দাবি প্রতিদিনের ভিত্তিতে, আবার কোথাও কোথাও গন্তব্য বা মালামালের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হয় আদায়যোগ্য অর্থের পরিমাণ। সাধারণত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের কর্মী কিংবা কিছু অসাধু পরিবহন নেতার নাম ব্যবহার করে এই টাকা আদায় করা হয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মদদ বা সহনশীলতা এই চাঁদাবাজদের উৎসাহিত করছে। এই অনৈতিক চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের পরিবহন খরচ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ওপর। একদিকে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ভোক্তাদেরও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ, এই চাঁদাবাজি একদিকে ব্যবসায়িক পরিবেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, অন্যদিকে জনজীবনকেও অতিষ্ঠ করে তুলছে। চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এমন অনেক দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র দোকানদার আছেন—যারা প্রতিদিন ১০০-২০০ টাকা চাঁদা না দিলে তাদের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো প্রতিবাদ করতে গেলে হুমকি, মারধর বা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার চাপ আসে। তাদের কোনো সহায়তা নেই, নেই সুবিচারের আশ্বাস। এমন এক ভয়াবহ অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং আইনের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। এই পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে এখনই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে যেতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যেসব সদস্য পরোক্ষভাবে এদের সহায়তা করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখানে কোনো রাজনৈতিক ছাড় বা প্রভাবকে প্রশ্রয় দিলে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন থেকে অবৈধ অর্থ আদায় বন্ধে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিটি বড় ট্রানজিট পয়েন্টে সিসিটিভি স্থাপন, পরিবহনপথে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো উচিত। এক্ষেত্রে জনগণকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে—যাতে তারা ভয়ভীতিহীনভাবে অভিযোগ জানাতে পারেন। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির জন্য চালু করা যেতে পারে বিশেষ হেল্পলাইন কিংবা মোবাইল অ্যাপস। তবে কেবল আইন প্রয়োগ করলেই সমাধান হবে না। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। আমাদের পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চাঁদাবাজির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা হওয়া জরুরি। তরুণ সমাজকে এ বিষয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে, যেন তারা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখে। একই সঙ্গে, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধানী রিপোর্টের মাধ্যমে চাঁদাবাজদের চিহ্নিত করা, প্রশাসনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা এবং জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ ও শৃঙ্খল সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম। চাঁদাবাজি শুধুই একটি অপরাধ নয়, এটি একটি অপরাধচক্র যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটি দুর্নীতি ও অবিচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যতক্ষণ পর্যন্ত এই চক্রকে চিহ্নিত করে মূল শিকড় উপড়ে ফেলা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা, আইন-শৃঙ্খলা এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। সুতরাং, এখনই সময় সরকারকে সাহসিকতার সঙ্গে এই চাঁদাবাজি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষত শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে রক্ষা করতে হলে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে, দলমত নির্বিশেষে সকল অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করলেই একটি চাঁদাবাজিমুক্ত, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন